প্রাথমিকভাবে সাম্রাজ্য বিস্তার এবং দক্ষ প্রশাসকের মাপকাঠিতে একজন সম্রাটের সাফল্যের বিচার হয়। কিন্তু মানবিক ধর্মকে জাগ্রত করে, প্রজাদের প্রতি অপার স্নেহে যিনি তাদের শাস্তির বারিধারায় সিঞ্চিত করেন, তিনি নিশ্চয়ই আরও বেশি মহান। অশোক বিচার্য এই তুলাদণ্ডে এবং আন্তর্জাতিকভাবেই তিনি স্বীকৃতি পেয়েছেন।
জীবনের পট পরিবর্তন
চন্ডাশোক থেকে রাজর্ষি অশোক। অশোকের জীবনে বিরাট পট পরিবর্তন। তাঁর জীবন শুরু হয় উদ্ধত, দুর্বিনীত রাজকুমার রূপে। এমনকি মৌর্য রাজপরিবারেও তিনি ত্রাসের সঞ্চার করেন। বিন্দুসারের মৃত্যুর পরে ভ্রাতৃহত্যা করে তিনি মগধের সিংহাসনে বসেন।
বিজেতা
"শক্তিমান মাত্রই যুদ্ধ করবে এবং শত্রু নিপাত করবে"- কৌটিল্যের এই আদর্শ অনুসরণ করে অশোক সিংহাসন লাভের পরেই পিতা-পিতামহের মতো অস্ত্রবলে সাম্রাজ্য বিস্তারে অগ্রসর হন। দুর্ধর্ষ কলিঙ্গ বাহিনীকে পরাজিত করা তাঁর রাজনৈতিক এবং সামরিক জ্ঞানেরও পরিচয় বহন করে।
নবজন্ম
কিন্তু কলিঙ্গা যুদ্ধই তাঁকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে যায়। অশোকের যেন নবজন্ম হয়। একই সঙ্গে বহুগুণের সমন্বয় ঘটে তাঁর জীবনে। অনেক ঐতিহাসিকই নিঃসংকোচে অশোককে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্রাটরূপে অভিহিত করেছেন।
শান্তিনীতি
তিনি যুদ্ধজয়ের পরিবর্তে শাস্তি ও মৈত্রীর নীতি গ্রহণ করেন। ইতিহাসে এই দৃষ্টান্ত বিরল। রাজার উপযুক্ত জ্ঞান ও সন্ন্যাসীর উপযুক্ত সাধুতা তাঁর মধ্যে ছিল। মানবতাবাদ ছিল তাঁর রাজাদর্শ। তিনি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের প্রতি বন্ধুভাব গ্রহণ করেন এবং ধর্ম প্রচার করে তাদের মন জয় করেন। তাঁরই নিরলস চেষ্টায় একটি স্থানীয় ধর্ম বিশ্ব ধর্মে পরিণত হয়। অশোকের ধম্ম বা অশোকবাদ ছিল শান্তি, মৈত্রী ও বিশ্বভ্রাতৃত্বের বাণী। অশোক নিজে বৌদ্ধ হলেও পরধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা ছিল তাঁর চরিত্রের একটি মহৎ গুণ। স্মিথের মতে, "অশোক মানব জাতির প্রথম ধর্মগুর।" মানবতাবাদী সমাজ গড়ে তোলাই ছিল অশোকের প্রধান উদ্দেশ্য। রোমিলা থাপার বলেছেন,
"It was a plea for the recognition of the dignity of man and for humanistic spirit in the activities of society." -A History of India
প্রজা প্রতিপালক
মানবহিতৈষী রূপেও অশোক বিশ্বে শ্রেষ্ঠ আসন লাভ করতে পারেন। প্রজাদের সম্বন্ধে তাঁর ধারণা 'সব মুনিষে পজা মমা' অর্থাৎ 'সকল মানুষই আমার সন্তান' ছিল তাঁর মানবিক চেতনার বিরাট অঙ্গ। প্রজার মঙ্গলের জন্য তিনি অসংখ্য জনহিতকর কাজ করে গিয়েছেন। অহিংসা নীতিকে অনুসরণ করে পশুর জন্য চিকিৎসালয় পর্যন্ত স্থাপন করেন। মানবীয় নীতিসমূহ শিক্ষা দেবার জন্য বিভিন্ন স্থানে ধর্মলিপি খোদাই করান। ব্যক্তি জীবনেও তিনি ন্যায়, নিষ্ঠা, অহিংসার আচরণ বিধি অক্ষরে অক্ষরে পালন করতেন।
সুশাসন
অশোক নিজেকে সুশাসকরূপেও প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর দীর্ঘ রাজত্বকালের মধ্যে কোথাও কোনো বিদ্রোহ বা প্রজা অসন্তোষ হয়নি। কাজেই অহিংসা নীতি অনুসরণ করলেও তিনি যে রাজ্য পরিচালনায় বাস্তবজ্ঞান সম্পন্ন ও দক্ষ ছিলেন, একথাই প্রমাণিত হয়। এক আদর্শ, এক ভাষা দিয়ে তিনি ভারতকে ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ করেন। একটি দেশকে গড়ে তোলার জন্য এ ছিল তাঁর শ্রেষ্ঠ অবদান।
শিল্প-সাহিত্য
তিনি দেশে অনেক স্তূপ, চৈত্য নির্মাণ করে ভাস্কর্য ও স্থাপত্য শিল্পেরও উৎকর্ষ বিধান করেন। তাঁর খরোষ্ঠী, ব্রাহ্মী লিপি দেশের সাহিত্য সৃষ্টিতেও প্রেরণা যোগায়।
মহিমা
অনেকে মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের জন্য অশোকের অহিংসা নীতিকে দায়ী করেন। মৌর্য সাম্রাজ্যের পতন যে কোনো কারণেই হোক না কেন তাতে অশোকের মহত্ত্ব ম্লান হয় না। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে,
"অশোকের আবির্ভাব ভারতকে মহিমান্বিত করেছে।"
অন্যান্য সম্রাটদের তুলনা
পৃথিবীর ইতিহাসে কনস্টানটাইন, ফ্রেডারিক, আলেকজান্ডার, আকবর, নেপোলিয়ন প্রমুখ অনেক বিখ্যাত সম্রাটের আবির্ভাব হয়েছে। কিন্তু অশোকের মতো সর্বতোমুখী প্রতিভাবান সম্রাট-আর কোথাও দেখা যায়নি। তাঁর রাজাদর্শ আজও বিশ্বে সমাদৃত হয়। তিনি ছিলেন বিশ্বশান্তির অগ্রদূত। তাঁর অবদান স্মরণ করে H. G. Wells মন্তব্য করেছেন,
"ইতিহাসের স্তম্ভে হাজার হাজার রাজাদের ভিড়ে অশোকের নাম উজ্জ্বল এবং নক্ষত্রের মতোই জ্বলজ্বল করছে"।
মন্তব্য
প্রজাকল্যাণ করে অশোক সত্যিই প্রকৃত রাজধর্ম পালন করেছেন এতে কোনো দ্বিমত নেই। তাঁর মানব কল্যাণের বাণী বিশ্বের সর্বজনীন কল্যাণে পরিণত হয়। আত্মত্যাগ, নিষ্ঠা এবং কর্তব্যকাজ দিয়ে তিনি শুধু স্থানীয় নয় বিশ্বের রাজাদের কাছে আদর্শ ও দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
কিন্তু তিনি বিজয়ী নীতি পরিহার করেননি, যদিও সে বিজয় সামরিক বিজয় না হয়ে হয়েছিল ধর্মবিজয়। এতে তাঁকে প্রশংসাকাঙ্ক্ষী বলেও মনে হতে পারে। ভেরিঘোষকে ধর্মঘোষে পরিণত করে অর্থাৎ সামরিক বাহিনীকে ধর্মপ্রচারের কাজ লাগিয়ে তিনি তাঁর বংশধরদের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করেন। ত্যাগ স্বীকার করেও সাম্রাজ্যের ভবিষ্যতকে ভাঙনের মুখে এগিয়ে দেওয়া নিশ্চয়ই হয়তো ঠিক হয়নি।
অশোকের আমলেই উত্তর-পশ্চিম ভারতে ব্যাকট্রীয় গ্রিক আক্রমণের আশঙ্কা ঘনীভূত হয়েছিল। এই সময় প্রয়োজন ছিল পুরুরাজ বা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের ন্যায় পরাক্রমশালী সম্রাটের। কিন্তু অশোক ছিলেন স্বপ্নাশ্রয়ী ও নির্বিরোধী সম্রাট। ফল হয়েছিল সাম্রাজ্যের বিপর্যয়। ডঃ হেমচন্দ্র রায়চৌধুরির মতে,
"Dark clouds were looming in the North-Western horizon. India needed men of the calibre of Poros and Chandragupta Maurja. She got a dreamer... The result was politically disastrous."-Political History of Ancient India.
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন